বাংলাদেশ থেকে কলম্বিয়াতে ব্যবসা
বাংলাদেশ থেকে কলম্বিয়াতে ব্যবসা করার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ও দেশের জনগণের স্বভাবজাত পছন্দের পরিবর্তনের কারণে আজ সে দেশে নতুন নতুন ব্যাবসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা তা জানার চেষ্টা করবো।
যেখানে ২০২২ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা স্কোর ৭২.১, সেখানে কলম্বিয়ার স্কোর ৬৫.১। যা আগের বছর থেকে ৩ পয়েন্ট কমেছে। প্রাথমিকভাবে সরকারের বিভিন্ন খরচ কমে যাবার কারণে এই স্কোর হ্রাসের কারন। যা ওই অঞ্চলের ৩২ টি দেশের মধ্যে কলম্বিয়াকে ছয় তম স্থানে নিয়ে এসেছে। সরকারের ব্যয় হ্রাস, বাজেটের সংস্কার, বিচারিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক মেরুকরণ সংস্কারের গতিকে ধীর করেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতামত অনুসারে কলম্বিয়া একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের অর্থনীতি হিসাবে পরিচিত, যা তাকে ল্যাটিন আমেরিকার বিশাল অর্থনীতির মধ্যে একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে গেছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মতোই কলম্বিয়ার অর্থনীতি তার ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কয়লা, পেট্রোলিয়াম, সোনা এবং কফি সে দেশের মূল রফতানি পণ্য, তা ছাড়াও কৃষি এবং শিল্প খাত কলম্বিয়ার অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
কলম্বিয়ার ৫২ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং সরকারের কঠোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অক্ষমতা সত্ত্বেও, দেশটিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক স্থিতিশীলতার ইতিহাস রয়েছে, যেখানে সেনাবাহিনী একটি বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
কলম্বিয়াতে বিভিন্ন ধরণের শ্রেণী পেশার মানুষ আছে। তবে সকল পেশার ভেতর অধ্যাপক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, আন্তর্জাতিক পরিবহন সেবা, বাণিজ্যিক ভাবে মাছ ধরা, ড্রেজিং, বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ক্রীড়াবিদের আদিখ্য দেখতে পাওয়া যায়।
দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এর প্রযুক্তি দল জানিয়েছে যে, ২০২২ সালে জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের তুলনায় ৭.৯%, আর ২০২৩ সালে এর সাথে আরো যোগ হবে ০.৫%।
কলম্বিয়াতে পাঁচটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র রয়েছে, তারা হলো বোগোটা, ব্যারানকুইলা, মেডেলিন, কার্টেজেনা এবং ক্যালি। যেখানে ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে মাত্র একটি বা দুটি বাণিজ্যিক বড় শহর আছে। কলম্বিয়ায় আমেরিকান ব্যাবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যায়, পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ব্যাবসায়ীদের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। তবে কলম্বিয়া মূলত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীর সংখ্যা বেশি। শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়িরা জাতীয় উত্পাদনশীল খাতের ৯০ শতাংশেরও বেশি এবং কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে।
কলম্বিয়াতে সম্পত্তির অধিকার সাধারণত স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত। যদিও বিচার ব্যবস্থাকে যোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবুও দেশটিতে দুর্নীতি, ঘুষ, প্রভাব বিস্তার সহ তথ্যের অপব্যবহার ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হয়।
অন্যদিকে, মাদক ব্যাবসায়ীদের জন্য সহিংসতা ও দুর্নীতি, জনপ্রশাসন বিভাগে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে গেছে। যা দেশের সাধারণ জনসাধারণের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও ব্যবসায়িক স্বাধীনতার মেট্রিক্সে কলম্বিয়ার ক্রমবর্ধমান উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে তবুও ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ কমেছে। অন্যদিকে সরকার ২০২০-২১ সালে বৈদ্যুতিক শক্তি, তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারীদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি প্রদান করেছে।
যদিও কলম্বিয়ার বাজার সাধারণত উন্মুক্ত এবং ব্যবসা-বান্ধব তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। অপ্রত্যাশিত আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলি অনেক সময় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য কঠিন হয়ে যায়। তেল, গ্যাস এবং খনি অনুসন্ধানের মতো শিল্পগুলি দীর্ঘ এবং জটিল পরিবেশগত লাইসেন্সিং পদ্ধতির মুখোমুখি হয়।
সেখানে আদিবাসী এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলি থেকে প্রকল্পগুলি চালানোর আগে গণভোট এর মতো মতামত গ্রহণের ব্যাবস্থা করা হয়।
তাছাড়াও কলম্বিয়াতে ব্যবসা করার জন্য লজিস্টিক খরচ কিছুটা ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে। তার কারণ, দুর্বল রাস্তার অবকাঠামো এবং বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশ্রেণীগুলির মধ্যে দিয়ে আপনার পণ্যকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে হবে, যে কারণে খরচটি অনেক বেড়ে যায়। তবে সে দেশের সরকার দেশের ভেতর নতুন রাস্তা তৈরী করতে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু তার সুফল আসতে অনেক বছর সময় লাগবে।
সে দেশের শিল্প খাতটি সাধারণত টেক্সটাইল, পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, জুতা প্রস্তুত, পানীয়, বিভিন্ন রাসায়নিক উৎপাদন, সিমেন্ট,জাহাজ নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স শিল্প, স্ট্র্যাচারাল বিভন্ন কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা যায় এমন যন্ত্রপাতি তৈরির ফ্যাক্টরি উল্লেখযোগ্য। অন্য দিকে কলম্বিয়ার শিল্প ও কৃষির ভেতর রয়েছে, খনির কয়লা, সোনা, পান্না, তেল, কৃষি ব্যবসা যেমন: ফুল, কলা, আখ এবং কফি।
অতীতের গৃহ যুদ্ধ থেকে অবকাঠামোর পুনরুদ্ধার, বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ভূমি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য বাধা, চরম দারিদ্র্যতা, প্রজনন অধিকারের সীমাবদ্ধতা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেশের মূল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা কলম্বিয়াতে গুরুতর উদ্বেগ হিসেবে রয়ে গেছে।
প্রকৃত পক্ষে কলম্বিয়ানরা অত্যন্ত ভদ্র একটি জাতি, যা তার আশেপাশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক ভালো। “ধন্যবাদ,” “আপনাকে স্বাগত” এবং “দয়া করে,” এই জাতীয় শব্দের যথেষ্ট প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
২০২১ থেকে ২০২২ সালে কলম্বিয়ার সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারকারীদের আচরণের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, প্রায় ৪১.৯ মিলিয়ন মানুষ এটিকে ব্যবহার করেছে। যা আগের বছর থেকে ৭.২% বেশি। যা মোট জনসংখ্যার ৮১.৩% ভাগ। এই সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা দৈনিক গড়ে ৩.৭৭ ঘন্টা সময় সেখানে খরচ করেছে। তাছাড়া প্রত্যেকের গড়ে ৭.৮ টি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
2022 এর শুরুতে এক গবেষণায় দেখা যায় যে মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগের গতি গড়ে ১৩.৩৪ Mbps, অন্য দিকে ব্রডব্যান্ড এর গড় গতি ৫৫.২১ Mbps । যা আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ৪.৭ এবং ৯১.৯ শতাংশ বেড়েছে। আরো দেখা যায় যে, কলম্বিয়ার বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করে।
২০২১ সালে কলম্বিয়ার আইসিটি বাজারের আকার ছিল প্রায় ৮.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ৮.৮% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধির হারে বাড়ছে। এটি ২০২৬ সালের ভেতর ১২.৯৮ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ICT এর এই বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব বৃদ্ধির একটি ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা ২০২২ থেকে ২০২৬ এর মধ্যে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়াও স্থানীয় লোকাল ব্যাঙ্কিং খাতে আইসিটির ধনাত্মক বৃদ্ধির কারণে ব্যপক উন্নতি হচ্ছে।
Covid-১৯ এর আগে কলম্বিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনে বিনোদন অনেক বড় অংশ জুড়ে ছিল। এক সমীক্ষা অনুসারে কলম্বিয়ার পরিবারগুলো থেকে ৭৮ ভাগ সদস্য মাসে একবার হলেও রেস্তোরাঁ এবং কফি শপে গিয়েছিল, ৭২ ভাগ বিভিন্ন মার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলো, ৪৩ ভাগ পানশালাতে এবং নাইটক্লাবগুলিতে গিয়েছিল অন্যদিকে ৪০ ভাগ সিনেমা হলে টিকিট কেটেছিল।
কিন্তু বর্তমানে মহামারীর পরে কলম্বিয়ানদের আর্থিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ৯০ ভাগ পরিবার তাদের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে, ৫০ শতাংশ পরিবারের আয় ৬০ ভাগের বেশি কমে গিয়েছে। মেট্ট্রোপলিটন শহরগুলোতে ৮৮ ভাগ এবং ৯৬ ভাগ ছোট শহর বা গ্রামীণ এলাকায়র মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবের কারণে, কলম্বিয়ানরা নিজ নিজ বাড়িতেই তাদের সাধারণ বিনোদন এর উপায় বের করে নিয়েছে।
আরো এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে দোকান এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ৬০ ভাগ ক্রেতা কমে গেছে। বিভিন্ন পার্কগুলিতে প্রায় ৫৩ ভাগ এবং মার্কেটগুলিতে ৩৯ ভাগ ক্রেতা কমে গেছে।
EY এর মতন প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে, মহামারীর ফলস্বরূপ, কলম্বিয়াবাসীদের বিনোদনের অভ্যাসগুলো অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। তারা অবসর সময় গুলোতে বাড়িতেই কম খরচে উপভোগ করে। এখন আর তাদের অবসরের সময় বাহিরে যাবার জন্য মন তাড়া দেয় না, বরং কিছুটা অলসতা কাজ করে আর অর্থনৈতিক বিষয়টিতো আছেই। এই সময়টিতে মানুষ ডিজিটাল মিডিয়াতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখছে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, নেটফ্লিক্স, টিকটক এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিজেদের সময় অতিবাহিত করতে দেখা যায়।
দেশের মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা আরো বেশি ইলেকট্রনিক পণ্যের বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথকে সহায়তা করেছে। কোলোম্বিয়ানরা ২০২২ সালে হোয়াটস অ্যাপ কে সব থেকে বেশি ব্যবহার করেছে। এছাড়াও গুগল এর ডাটা দেখায় যে ৩০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী তাদের ইউটুব অ্যাপ ব্যবহার করেছে। এর ভেতরে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মোট ব্যবহারকারীর ৮৫ ভাগ ইউটুবের বিজ্ঞাপন গুলোতে এনগেজ হয়েছে।
কলম্বিয়াতে একসময় উবার অ্যাপটি বৈধ ছিল, কিন্তু ২০২০ সালে এক মামলায় হেরে গিয়ে উবার অ্যাপটি অবৈধ হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে উবার আরো শক্তিশালী হয়ে কিছুটা অবৈধ ভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরে আসে। মানুষ এটার প্রতি ব্যাপক আসক্ত, যদিও পুলিশ প্রশাসন চেষ্টা করছে তা ব্যবহার করতে প্রতিহত করতে।
কিন্তু শেষ কথায় বলা যায় যে, প্রায় ৫২ মিলিয়নের দেশ কলম্বিয়া, যেখানে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হতে পারে।