মানসিক স্বাস্থ্য একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রত্যেক মানুষ শান্তিতে থাকলে অসুখ কম হয়। অন্যদিকে বড়দের মানসিক সুস্থতা থেকেও শিশুদের মানসিক সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে তার আশেপাশের পরিবেশের উপর। একটি বড় মানুষকে আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন খুব বদ মেজাজি, বাবা ও মায়ের সাথে খুব খারাপ আচরণ করছে,প্রচুর মিথ্যা কথা বলছে অথবা পড়াশুনায় খারাপ করেছে । এমন বিভিন্ন সমস্যাযুক্ত মানুষদের পিতা-মাতা বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ওই মানুষের জীবন বৃত্তান্ত অর্থাৎ শিশুকাল, বয়ঃসন্ধিকাল ও যুবক বয়সের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, এদের শিশুকাল মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। তাছাড়া মনোবিজ্ঞানীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে থাকা শিশুদের উপর ব্যাপক গবেষণা করে দেখেছেন যে ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়। সেই ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহনশীলতা থাকা খুবই প্রয়োজন। মানুষের শারীরিক সুস্থতা যেমন দরকার, ঠিক তেমনি মানসিক সুস্থতা একান্ত প্রয়োজন।
একটা সময় আমাদের দেশে প্রচুর যৌথ পরিবার দেখা যেত, তবে তা এখন অতীত বলা যায়। কারণ এখন প্রায় সব পরিবারিই একক পরিবার। এতে করে শিশুর খেলাধুলা, গল্প করা বা অন্য শিশুদের সাথে সময় কাটানো তেমন হয়ে উঠে না। একক পরিবারগুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই বাবা-মাকে অনেক বেশি ব্যাস্ত থাকতে হয়, তাই শিশুটির সঙ্গী হয় টিভি অথবা এনরোয়েড মোবাইল ফোন।
দশটি শিশুর উপর একটি গবেষণা করা হয়েছিলো, তাদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে মোবাইল ফোন ও একটি পাত্রে কিছু বালি দেওয়া হয়েছিলো। তাদেরকে বলা হলো তোমরা ওই দুটি জিনিস থেকে যেকোন একটি নিয়ে সময় কাটাতে পারবে, বেঁছে নাও। দেখা গেলো দশ জনের ভেতর নয়জন বালিকে বেছে নিয়েছিল,আর একজন নিয়েছিল মোবাইল ফোন। এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, শিশুরা বালিকে অনেক পছন্দ করে এবং মোবাইল ফোন তাদের প্রথম পছন্দ নয়।
আসলে শিশুরা তাদের সাথী চায় এবং বাবা-মাকে সেই সাথী হতে হবে। শিশুদেরকে সবার সাথে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয়, তারা উদার হয়, অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে শিখে। সবার সঙ্গে মিশে যেন সমাজে চলতে পারে।
একটি শিশুর কিছু বিষয় খেয়াল করলেই বুঝা যাবে যে, তার থাকার পরিবেশেটি সঠিক কিনা?
১. যদি আপনার শিশুটি স্কুলের প্রতি অনীহা দেখায়, বা স্কুলে যেতে না চায়। অথবা স্কুলে মাঝে মাঝে মারামারি করে, পড়াশুনায় উদাসীন হয়।
২. আবার স্বাভাবিক অবস্থায় হঠাৎ করে রেগে যাচ্ছে, খিট খিটে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে, বাবা-মা বা বাহিরের মানুষের সাথেও দুর্ব্যবহার করছে।
৩. মাঝে মাঝে শিশুর মাথা ব্যাথা করছে বলে আপনাকে জানাচ্ছে, ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখছে। ৪. আপনার শিশুটি জীবনে চলার পথে এমন সব বিষয় নিয়ে মন খারাপ করছে যে, যা খুবই সামান্য। সাধারণ বিবেচনায় ওই সকল বিষয় নিয়ে কেও মন খারাপ অথবা কান্নাকাটি করে না, আবার কখনোবা শিশুরা বড় মানুষদের মতো বিষণ্ণতায় ভোগে।
৫. এমনও হতে পারে, আপনার শিশুটি মানুষিক ভাবে খুবই দুর্বল, ছোটোখাটো বিষয়ে অনেক ভয় পায়।
৬.শিশু প্রচুর মিথ্যা কথা বলে থাকে। বাড়িতে কারণে-অকারণে হিংস্র হয়ে ওঠে, ভাইবোনদের সাথে ঝগড়াঝাটি শুরু করে এমন কি ঘরে ভাঙচুর করে।
৭. অনেকে ঘুমের ভেতর রাতের বেলা বিছানায় প্রস্রাব করতে শুরু করে। অথচ তারা বিছানায় প্রস্রাব করা বহু আগেই হয়তোবা ছেড়ে দিয়েছিল। এটি সাধারণত বাবা মায়ের ভেতর ব্যাপক ঝগড়া-ঝাটি থাকলে দেখা যায়।
৮. কখনো কখনো বাসার কাজের মানুষের প্রতি খারাপ বা নিষ্ঠুর ব্যবহার করে।
৯. চুরি!! যে কোনো কিছুই চুরি করা। ছোট বেলায় আমার একজন বন্ধু ছিলো,সে চুরি করতো। কিছু চুরি করার আগে সে ওই বিষয় নিয়ে ওই জিনিসের মালিকের কাছে অনেক কিছু জানতে চাইতো। শেষে জানিয়ে আসতো, এইটা আসলেই অনেক সুন্দর, এই জাতীয় অনেক কথা বলতো। এরপর সেটা আর পাওয়া যেত না,সে সেটা চুরি করতো। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম, ওর মায়ের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক ভালো ছিল না, তাদের পরে ডিভোর্স হয়ে যায়।
শিশুর মানসিক সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে নিচে তা আলোচনা করা হলো :
- বাবা -মায়ের শিশুদের কাছ থেকে খুব বড় কিছুর প্রত্যাশা করা ঠিক না।
- মূল সমস্যাটি শুরু হয় বাবা মায়ের নিজেদের ভেতরকার খারাপ সম্পর্ক থেকে তাই ভালো সম্পর্ক রাখতেই হবে। সম্পর্ক খারাপ থাকলেও শিশুদের সামনে নিজেদের আদর্শ বাবা-মা হিসেবে অভিনয় করতে হবে।
- স্কুলে কোনো রকম বাজে পরিস্থিতি বা ব্যাবহারের মুখোমুখি হয়েছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা।
- শিশুটির জীবনকে সহজ সরল করে রাখতে হবে, পরিবারের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে শিশুকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এবং অবশ্যই শিশুদের উপর খুব বেশি আস্থা রাখবেন না। কারণ তারা যেকোনো সময় ভুল করতে পারে, আবার তার উপর খুব বেশি তদারকিও করবেন না। সারাক্ষন এটা কর ওটা করো এমন করবেন না, অর্থাৎ অতিরিক্ত আদর বা শাসন কোনোটাই করবেন না। তার জীবন অতিষ্ট করে তুলবেন না,তার স্বাভাবিক প্রবণতাকে সম্মান করুন।
- শিশুর রাগ ,হিংসা থাকবেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তাকে বকা বা মন্দ কথা বলা যাবে না। তাকে ধীরে সুস্থে একটু সময় নিয়ে বুঝাতে হবে।
- যখন শিশু কিছু বলতে চায় তখন, যে অবস্থাতেই আপনি থাকুন না কেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনুন।
- শিশুর সামনে আপনারা পোশাক পরিবর্তন করবেন না, বিশেষ করে আমরা যখন বাহির হতে ঘরে ফিরি, এই বিষয়টি শিশুটি উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
- অবশ্যই কখনো শিশুটিকে অন্য কারো সাথে তুলনা করবেন না। যেমন; আমরা অনেক সময় বলে থাকি, অমুক পারে তুমি পারো না কেন? এতে শিশুটির মনে প্রতিহিংসার সৃষ্টি হয়, কিছু একটা উল্টাপাল্টা করে দেখানোর চিন্তা চলে আসে।
- মাঝে মাঝেই খোলা প্রান্তরে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তার সাথে খেলবেন।
- তাকে জীবন, টাকা, সময় ও পরিশ্রমের গুরুত্ব বুঝাতে চেষ্টা করবেন।
- তার হাতে ইন্টারনেট সহ মোবাইল দিয়ে দিবেন না। যদি একান্ত ইউটুবে কাৰ্টুন বা গান দেখাতে চান তবে বড় কোনো মনিটরে দেখান, যেন আপনারা নিজেরাও দেখতে বা শুনতে পারেন, সে কি দেখছে বা শুনছে?
- শিশুটির পড়াশুনার রেজাল্ট যেমনটিই হোক কেন, বিষয়টি খুব স্বাভাবিক ভাবে নিবেন। অভিজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে ধীরে সুস্থে কর্মপ্রণালী ঠিক করুন।
- তার কোনো কিছু সৃষ্টিকে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করুন, প্রশংসা করুন।
- শিশুকে বাহিরের মানুষের সামনে বকাঝকা করবেন না, এতে সে চরম ভাবে অপমানিত হয়। এতে মনের ভেতর চাপা ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
- আপনার শিশুকে সকলের কোলে দিবেন না, সে যার কাছে যেতে চায় না, আপনি জোর করবেন না তার কাছে যেতে।
- শিশুকে অনেকে চেপে ধরে আদর করে, দেখা গেছে যে অধিকাংশ শিশুই হামি অথবা বড়দের এই জাতীয় ভালোবাসা খুবই অপছন্দ করে। এবং তার মনে একটা চরম অসস্থির সৃষ্টি হয়
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সাহায্য করে কোন হরমোন:
একটি মানুষ শিশু কাল থেকে পূর্ণাঙ্গ যুবক হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টার বৃদ্ধি মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত করে বেশ কয়েকটি হরমোন। সেগুলো হচ্ছে Thyroid hormone, Growth hormone, ও Insulin, এই সকল হরমোনের সুসংঘটিত কার্যক্রমের মাধ্যমে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন:
প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস, ১৯৯২ সালে পৃথিবীতে প্রথমবার পালন করা হয়েছিল। আমরাও বাংলাদেশে ওই বছর থেকেই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন করে আসছি।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নাম ও ঠিকানা:
- জাতীয় মানসিক হাসপাতাল, হেমায়েতপুর, পাবনা
- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
- সাইক্রিয়াট্রিক ইউনিট (বহির বিভাগ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, শাহবাগ, রমনা, ঢাকা
- সাইক্রিয়াট্রিক ইউনিট (বহির্বিভাগ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বকশী বাজার, রমনা, ঢাকা
- সাইক্রিয়াট্রিক ইউনিট (বহির্বিভাগ), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিডফোরড রোড, ঢাকা
- শিশু বিকাশ কেন্দ্র, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিডফোরড রোড, ঢাকা
- শিশু বিকাশ কেন্দ্র, শিশু হাসপাতাল, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
- ইন্সটিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এবং অটিজম, ব্লক- ই, ফাস্ট এবং সেকেন্ড ফ্লোর, আইপিএনএ, ১ম ও ২য়, BSMMU, ঢাকা
- ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ৩৭/৩ ইস্কাটন গার্ডেন রোড, ৩য় তলা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ভবন, ঢাকা
- আইন ও সালিস কেন্দ্র(ASK), ৭/১৭, ব্লক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা
- বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন(বিপিএফ), ৬, বড়বাগ, পোস্ট অফিসের গলি, সেকশনঃ ২, মিরপুর-১২১৬, ঢাকা
- ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার(ওসিসি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বকশী বাজার, রমনা, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট(NPU), ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ৪র্থ তলা, কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাদেশের সকল শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ঠিকানা পেতে এই লিংকে যান।
শিশুদের প্রস্রাবের সমস্যা একটি বেশ বড়ো ঝামেলা হইয়ে অনেক সময় দেখা দেয়। এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
উপসংহার: সবশেষে একটি কথা, আর তা হলো একটি গাছ যেমন নিজের মতো করে বড় হয়, আপনি শুধু তার যত্ন, খাবার ও সার প্রদান করেন তেমনটি একটি শিশুর ক্ষেত্রেও তা প্রযজ্ঞ । একটি শিশু ছোটবেলায় যেমন ব্যবহার দেখতে দেখতে বড় হবে, তেমন ব্যবহার আপনার সাথে একসময় অনায়াসে করে বসবে।