স্বাস্থ্যজীবনযাপন

ক্যান্সার থেকে মুক্তি! Freedom from cancer

 

ক্যান্সার থেকে মুক্তি

ক্যানসার একটি মারণ রোগ ৷ এই রোগের ওষুধের উপর বহু বছর ধরে গবেষণা চলছে, এখন পর্যন্ত ভালো কোন মেডিসিন তৈরী হয়নি। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তবে আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই জটিল রোগটির কিছু প্রতিরোধক খাদ্য নির্ধারণ করেছেন।

ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়:

ক্যানসার থেকে মুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট এমন কোনো খাবার নাই, যেটি খেলে আপনি রাতারাতি সুস্থ হয়ে যাবেন। দৈনন্দিন জীবনযাপন একটু রুটিন মাফিক করতে হবে, এবং নিচে খাবার গুলো নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।

বাদাম (Nuts):

ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার কোলন, ফুসফুস, যকৃত, এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। বাদাম ভিটামিন ই এর সবথেকে ভালো উৎস।প্রতিদিন সকালে কিংবা বিকালের খাবারে বাদাম রাখুন। এ ছাড়াও এক চামচ বাদামের মাখন লাগানো এক টুকরো পাউরুটি আপনার শরীরকে ক্যান্সার থেকে দূরে রাখতে পারে। বাদামে প্রচুর পরিমানে পুষ্টিগুণ থাকে।  বাদামের মধ্যে প্রয়োজনীয় ফ্যাট থাকে যা হৃদপিণ্ডের সুস্থতার জন্য দরকার। আপনাকে অনেক পরিমাণ পুষ্টি প্রদানে সক্ষম অল্প পরিমাণ বাদাম। বাদামে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকার পাশাপাশি পটাশিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ফোলেট, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন ই থাকে। প্রোটিন ও ফাইবার ও থাকে বাদামে। বাদামে সেলেনিয়াম নামক অ্যান্টি ক্যান্সার উপাদান বিদ্যমান থাকার কারণে কোলন, ফুসফুস, যকৃত, এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। তাই সকালে কিংবা বিকালের নাস্তায় বাদাম রাখা যাতে পারে।

লেবু (Lemon):

বাতাবিলেবু, কমলালেবু, কাগজিলেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি ক্যান্সার হওয়ার জন্য দায়ী নাইট্রোজেন যৌগের গঠন রোধ করে থাকে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাদ্যনালী, মূত্রাশয়, স্তন ক্যান্সার, সার্ভিকাল ক্যান্সার, এবং পেট ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তাই প্রতিদিন আপনার খাদ্য তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল রাখুন।

মিষ্টি আলু (Sweet potato):

মিষ্টি আলুতে বিটা ক্যারোটিন থাকে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চ মাত্রায় বিটা ক্যারোটিন শরীরে থাকলে তা কোলন, স্তন, পেট ও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় আরও প্রমানিত হয়, যে সব মহিলারা মিষ্টি আলু তাদের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখেন তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমে যায়।

হলুদ (Yellow):

হলুদের মধ্যে বিদ্যমান সবথেকে সক্রিয় একটি উপাদান ‘কারকিউমিন’ যা নামে পরিচিত। এটি প্রদাহজনিত সমস্যা বিরোধী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট  হিসাবে কাজ করে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মানব দেহের টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দেহকে ক্যান্সার প্রতিরোধী করে তোলে। তাই শরীরকে ক্যান্সার প্রতিরোধী করতে চাইলে কাঁচা হলুদ অথবা মাছ ,মাংসের ও বিভিন্ন রকম তরকারিতে প্রয়োজন মত গুঁড়া হলুদ ব্যাবহার করে খেতে পারেন।

চা (Tea):

চাতে রয়েছে ক্যাটচীন নামক একটি যৌগ। এই যৌগটি মানবদেহকে ক্যান্সারের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে থাকে । সম্প্রতি চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা চা পান করেন তাদের ফুসফুস, প্রস্টেট, কোলন এবং স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যারা চা পান করেন না তাদের থেকে অনেক কম।

গ্রিন টি (Green tea):

সাধারণত গ্রিন টি বা সবুজ চা ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক উপকারী হয়ে থাকে। তাই সাধারণ চায়ের তুলনায় গ্রিন টি বেশি উপকারী হওয়ায় চা না খেয়ে গ্রিন টি বা সবুজ চা খেতে পারেন।

বেদানা (Pomegranate):

বেদানায় ‘এলাজিক অ্যাসিড’নামক উপাদান রয়েছে। যা মানব দেহে ক্যান্সারের জন্য দায়ী যৌগকে প্রতিহত করে ও ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি বন্ধে সাহায্য করে থাকে। তাই পরিবারের সবাইকে বেদানা খাবার জন্য উৎসাহী করুন। সালাদ, জুস, মিল্কশেক অথবা সরাসরি বেদানা খাওয়া যেতে পারে।

টমেটো (Tomato):

টমেটোতে আছে ‘লাইকোপিন’ নামক ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান। লাইকোপিন দেহে  প্রস্টেট ক্যান্সার সহ অন্যান্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। তাই পুরুষ ও মহিলা প্রত্যেকের সপ্তাহে অন্তত তিনটি টমেটো খাওয়া অত্যান্ত জরুরি।

গাজর (Carrot):

আমরা জানি চোখের দৃষ্টি শক্তির জন্য গাজর (Carrots) ভীষণ উপকারী একটা সবজি। কিন্তু গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, শুধুমাত্র চোখ নয়, গাজর কয়েক ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধেও বেশ কার্যকর, বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যান্সার। গাজরে রয়েছে beta-carotene, lycopene, lutein, and zeaxanthin যা Carotenoids হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত এবং এটা শরীরের  ক্যান্সার প্রতিরোধক শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সপ্তাহে তিনবার গাজর খেলে শতকরা ১৮% ভাগ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

ফুলকপি (Cauliflower):

ফুলকপিতে ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, প্যান্টোথেনিক,ভিটামিন বি৬,মিনারেলস এবংসালফোরাফেন নামে এক ধরনের যৌগ রয়েছে,যা শরীরে ক্যান্সারের টিউমার বৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেয়।  এজন্য ফুলকপি ভাল করে চিবিয়ে খেতে হবে, যাতে সালফোরাফেন যৌগটি শরীরের নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষ গুলো ধ্বংস করতে পারে।

অ্যাভোকাডো (Avocados):

অ্যাভোকাডো (Avocados) ফল হিসেবে অনেকের পছন্দের তালিকাতে না থাকলেও খাবার হিসেবে এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর। বিশেষ করে, অ্যাভোকাডোতে রয়েছে শক্তিশালী  আন্টি -অক্সিডেন্টস এবং ফিটোকেমিক্যালস। পাশাপাশি ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবার ও অনু  নামে এক ধরনের শক্তিশালী ফ্যাট রয়েছে, যা Acute Myeloid Leukaemia (AML) প্রতিরোধক হিসাবে প্রমাণিত।  তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অ্যাভোকাডোর উপস্থিতি আপনার শরীরের অস্বাভাবিক কোষ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করবে।

ব্রকলি (Broccoli):

ব্রকলি (Broccoli)-তেও ফুলকপির মতো শক্তিশালী সালফোরাফেন রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে বিশেষ ভাবে উপযোগী। তাই নিজেকে সুস্থ্য রাখতে এবং জটিল রোগ থেকে দুরে থাকতে ব্রকলি আপনার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।

আদা (Ginger):

আদা একটি উদ্ভিদ মূল, যা মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে রোয়েছে এন্টি-অক্সিডেন্ট ,এন্টি-ইনফ্লামেটরী এবং এন্টি-টিউমার এফেক্টস। এ ছাড়া আদার অনেক প্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে যেমন-  জ্বর, ঠাণ্ডা,  হার্টের সমস্যা,  কোলেস্টেরল কমানো, আর্থ্রাইটিস সহ ক্যান্সার-এর মত জটিল অসুখ নিরসনে আদা কার্যকরী ভূমিকা রাখে।  ক্যান্সার নিরাময়ের প্রতিষেধক হিসাবে প্রচলিত কেমোথেরাপি থেকে আদা ১০,০০০ গুন বেশি শক্তিশালী মেডিসিন যা শরীরের নিদৃষ্ট ক্যান্সার কোষ  গুলো ধংস করতে সাহায্য করে।

রসুন (Garlic):

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় রসুনের স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক বেশি। বিশেষ করে নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা দূর করতে রসুনের জুড়ি নেই। তবে রসুনের অন্যতম প্রধান উপকারিতা হচ্ছে এটি শরীরের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে ক্লোন,স্টমাক,এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার। রসুন এমন একটি উপকারী ও শক্তিশালী খাদ্য যার এন্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট শরীরের ক্ষতিকর ক্যান্সার কোষ এর ছড়িয়ে পরাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

তরমুজ (Watermelon):

ফলের মধ্যে তরমুজ অনেক উপকারী। এই তরমুজের এক টুকরাতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রতিদিনের চাহিদার ৮০% ভিটামিন সি, ৩০% ভিটামিন এ ও বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান থাকে। তাছাড়া তরমুজেও লাইকোপেন থাকে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। বর্তমান এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফল ও শাকসবজিতে ফুসফুস, মুখের, খাদ্যনালীর এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকির মুক্তি পাওয়া যাবে।

 সবুজ শাক (Green vegetables):

সবুজ শাক ফাইবার, ফোলেট, ক্যারোটিনয়েড ও ফ্লেভনয়েডের চমৎকার উৎস। এই যৌগ গুলোর বেশীর ভাগেরই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপকারিতা আছে যা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। ফলে ক্যান্সারের প্রতিরোধে সবুজ শাক অনেক উপকারী তাই বেশি বেশি করে সবুজ শাক সবজি খাওয়া ভাল।

 পেঁয়াজ (Onion):

নিয়মিত পেঁয়াজ খেলে পাকস্থলীর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। পুষ্টিবিদদের মতে পিঁয়াজেরও রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান যা টিউমারের বেড়ে ওঠাকে বিলম্বিত করে। সুতরাং রান্নার ক্ষেত্রে পিঁয়াজ অনেক উপকারী।

মাশরুম (Mushroom):

আধুনিক খাবার হিসেবে বাংলাদেশে মাশরুমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটছে। যে-সকল ব্যক্তি মাশরুম সংগ্রহ করে খায়, তারা মাইকোফেজিস্টস বা ‘মাশরুম খাদক’ হিসেবে পরিচিত। মাশরুম খোঁজার প্রক্রিয়াকে সাধারণত: মাশরুমিং বা মাশরুম শিকারি নাম বলা হয়। মাশরুমে রয়েছে  ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান। এছাড়াও রয়েছে পুষ্টি ও ভেষজগুণ যা রোধ করবে ক্যান্সার।

কালো চকলেটে (Dark chocolate):

কালো চকলেটেও রয়েছে এন্টি ক্যান্সার প্রপার্টি। কালো চকলেটের পলিফেনলস ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। তাছাড়া কালো চকলেট বা ডার্ক চকলেট নিয়ে একাধিক গবেষণায় বিশেষজ্ঞগণ দেখেছেন কালো চকলেট রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করে এবং রক্তনালী কোমল রাখে তাই হার্টের জন্য ভালো। তবে অধিক কালো চকলেট খাওয়া যাবে না।

সি ফিস বা সামুদ্রিক মাছ (Sea fish):

সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের রিদমকে দ্রুততর করে, ধমনীতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনীতে পুরনো প্রদাহকে ঠাণ্ডা রাখতে এবং রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক। গবেষকেরা জানিয়েছেন হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে একজন মানুষের ১৭৫০ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড দরকার পড়ে। আর এই সামুদ্রিক মাছের মধ্যে বিদ্যমান থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাট এসিড যা প্রদাহ প্রতিরোধ করে ফলে দেহের ক্যান্সারের রূপ নিতে বাধা দেয়।

খেজুর (Dates):

ক্যান্সার প্রতিরোধ অবাক হলেও সত্য খেজুর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এক গবেষনায় দেখা যায় খেজুর পেটের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আর যারা নিয়মিত খেজুর খান তাদের বেলায় ক্যান্সারের ঝুঁকিটা কমে যায় অনেকখানি।

কাঁচামরিচ (Chili):

শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত উপাদান দূরকরে কাঁচামরিচ এর এন্টিঅক্সিডেন্ট। বেরিয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যান্সার সেল জন্ম নেয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।

সজনা ও বরবটি:

সজনা ও বরবটি প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার।  এগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য দেহকে প্রস্তুত রাখে। যখন সময় মত এই দুটি সব্জি বাজারে পাবেন তখন কোন চিন্তা না করে কিনে ফেলুন এবং আপনার খাদ্য তালিকায় রাখুন।

চিনিযুক্ত পানীয় বাদ দিন:

চিনিযুক্ত পানীয় স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিযুক্ত পানীয় পানে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে প্রায় ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত। তাই চিনিযুক্ত পানীয় যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।

অ্যালকোহল পরিহার করুন:

অতিরিক্ত অ্যালকোহল মুখ, গলা, খাদ্যনালী, এবং স্বরযন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়,তাই অ্যালকোহল পুরোপুরি পরিহার করতে হবে।

 বসে থাকার অভ্যাস কমাতে হবে:

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে যারা দিনের বেশির ভাগ সময় বসে কাটায় তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে ২৪ শতাংশ বেশি। তাই একটানা বসে না থেকে এক ঘন্টায় অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য হলেও চারপাশে পায়চারি করাতে হবে।

ক্যান্সার থেকে মুক্তির জন্য কিছু সতর্কতা:

১. অর্গানিক নয় এমন খাবার খাওয়া থেকে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

২. ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও আলুর চিপস খাওয়ার আগে একটু চিন্তা করুন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও আলুর চিপস তৈরিতে ক্ষতিকর ও অস্বাস্থ্যকর স্ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার করা হয়। ট্রান্সফ্যাটের সমস্যার কথা আমরা বহু আগ থেকে জানলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, এসব স্ন্যাকজাতীয় খাবারে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী অ্যাক্রাইলেমাইড নামের এক রাসায়নিক যৌগ উপস্থিত থাকে।

ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট বলেছে, অ্যাক্রাইলেমাইডের এক বড় উৎস হল খাবার। অনেক খাবারে অ্যাক্রাইলেমাইডের উপস্থিতির কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ ভীষণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

প্রচণ্ড উত্তাপে দীর্ঘক্ষণ ধরে খাবার ভাজি, রান্না বা পোড়ানো হলে অ্যাক্রাইলেমাইড উৎপন্ন হয়। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মচমচে করে তৈরি করা হলে অ্যাক্রাইলেমাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এসব কথা পড়ে তাহলে কি আমরা আলুর স্ন্যাক খাওয়া বন্ধ করে দেব? না তার প্রয়োজন নেই।

আলুর সব ধরনের খাবার আমরা ঘরেই প্রস্তুত করতে পারি। তবে সেই ভাজি বা রান্না হতে হবে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় অল্প সময়ের জন্য। ফ্রাই করার পর তৈরি খাবার ওভেনে রেখে শুকিয়ে নিলে খুব ভালো হয়।

৩. মাইক্রোওয়েভে তৈরি পপকর্ন বা ভুট্টার খই খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে আজকাল আমাদের অনেক কাজ খুব সহজ হয়ে গেছে। মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে আজকাল ঘরে ঘরে ভুট্টার খই তৈরি করা হয়। এক ধরনের বিশেষ থলেতে ভুট্টা রেখে মাইক্রোওয়েভে দিলে মিনিটের মধ্যে ম্যাজিক শুরু হয়ে যায়।

কিন্তু এ পদ্ধতিতে খই তৈরি করে খাওয়ার মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে। যে থলেতে ভুট্টা রেখে খই তৈরি করা হয়, তা থেকে পারফ্লোরোঅক্টানোয়িক অ্যাসিড (Perfluorooctanoic acid) নামের এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ উৎপন্ন হয়।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এ রাসায়নিক যৌগ লিভার, কিডনি, প্যানক্রিয়াসসহ আরও কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। মাইক্রোওয়েভে খই তৈরি করার সময় ডাইঅ্যাসিটাইল নামের অন্য এক রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে, যা ক্যান্সার ছাড়াও ফুসফুসের সমস্যা তৈরি করতে পারে। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য খই তৈরি করার জন্য মাইক্রোওয়েভের পরিবর্তে সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

৪. লাল মাংস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে। গরু, মেষ, শূকর ও অন্যান্য পশুর লাল মাংস সুষম খাবারের উৎস, যা শাকসবজি ও ফলমূলে পাওয়া যায় না। অতিমাত্রায় লাল মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়- এ কথাটি পুরনো হলেও লাল মাংস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, এ কথাটি অতি সম্প্রতি জানা গেছে।

দি ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ড এবং অ্যামেরিকান ইন্সটিটিউট ফর ক্যান্সার রিসার্চ প্রকাশ করেছে, যেসব মানুষের খাবারে লাল মাংসের আধিক্য থাকে, তাদের প্যানক্রিয়াস, পাকস্থলী, ফুসফুস, উওসোফেগাস, ব্রেস্ট ও এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। লাল মাংস রান্নার জন্য দীর্ঘক্ষণ ধরে উচ্চতাপ প্রয়োগ করতে হয়। অনেকে আবার পোড়া লাল মাংস খেতে পছন্দ করে। এসব পদ্ধতিতে লাল মাংস রান্না করার সময় মাংসে হেটারোসাইক্লিক এমিন তৈরি হয় যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।

লাল মাংসে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত চর্বি থাকে, যা স্তন ও মলাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টির সহায়ক। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য লাল মাংস বর্জন করা উত্তম। আর সম্পূর্ণ বর্জন করা না গেলে লাল মাংস খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে পোড়া লাল মাংস কোনোমতেই খাওয়া উচিত হবে না।

৫. বিশ্বব্যাপী স্থূলতা এক বড় ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্থূল মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকে বেশি আক্রান্ত হয়। স্থূলতার ভয়ে আজকাল অসংখ্য মানুষ চিনির পরিবর্তে ডায়েট, জিরো ক্যালরি এবং লো-ক্যালরির কৃত্রিম চিনিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ক্যালরিবিহীন কৃত্রিম চিনি ওজন কমাতে বা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করলেও ক্যান্সার তৈরিতেও ভূমিকা রাখে- এ কথাটি খুব কম মানুষই জানে। কৃত্রিম চিনি হিসেবে পরিচিতি অ্যাসপার্টেম চিনির চেয়ে দুইশ’ গুণ বেশি মিষ্টি।

এটা অতি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত অ্যাসপার্টেম ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক ডায়েট খাবারে অনাবশ্যকীয় কৃত্রিম রং, রাসায়নিক যৌগ ও প্রিজারভেটিভ থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়া এটা অতি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত অ্যাসপার্টেম ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক ডায়েট খাবারে অনাবশ্যকীয় কৃত্রিম রং, রাসায়নিক যৌগ ও প্রিজারভেটিভ থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। আমি মনে করি, কৃত্রিম চিনির চেয়ে অল্প চিনি খাওয়া অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। ওজন কমানোর জন্য বা ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃত্রিম চিনি বা চিনি গ্রহণ না করেও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে এসব স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করা যায়। সুষম খাবার, ব্যায়াম ও লাইফস্টাইল পরিবর্তন মানুষকে বহু স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে রক্ষা করে।

৬. পরিশোধিত খাদ্যশস্য দিয়ে প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের ক্ষুধা মেটাচ্ছি। রুটি, প্যাস্ট্রি, সাদা চাল, ময়দা, পেস্তা হল কর্বোহাইড্রেট বা শর্করার প্রধান উৎস। এসব খাবার আমাদের প্রতিদিনের শক্তি জোগায়।

কারণ এসব পরিশোধিত খাদ্যশস্য অতি সহজে ও অল্প সময়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং শরীরের কোটি কোটি কোষে পৌঁছার জন্য রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ দ্রুত সৃষ্ট গ্লুকোজ শুধু সাধারণ কোষের শক্তি জোগায় না, ক্যান্সার কোষের শক্তিও জোগায়। পরিশোধিত খাদ্যশস্য স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের অন্যতম এক কারণ হলেও তা ক্যান্সার সৃষ্টি করে না।

ক্যান্সার কোষ বা টিউমারের বয়োবৃদ্ধি ও সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে এ পরিশোধিত খাদ্যশস্য। পরিশোধিত খাদ্যশস্য বিশেষ করে ময়দা সাদা করার জন্য ক্লোরিন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। দ্য এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির সূত্রমতে, ক্লোরিন গ্যাস মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী। ক্যান্সার কোষ বা টিউমারের বয়োবৃদ্ধিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যা প্রতিরোধের জন্য পরিশোধিত খাদ্যশস্যের পরিবর্তে সম্পূর্ণ শস্য বা ভুসিযুক্ত শস্য খাওয়া আবশ্যক। হোলগ্রেইন বা সম্পূর্ণ শস্যে প্রচুর আঁশ ও পুষ্টিকর উপাদান থাকে। সম্পূর্ণ শস্য খেলে মলাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুলাংশ কমে যায়।

৭. সোডা অতি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত পানীয়। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে এক বোতল ঠাণ্ডা মৃদু হিস্হিস্ শব্দ করা মিষ্টি জাতীয় সোডা যে কাউকে অপরিসীম তৃপ্তি দিতে পারে। সোডা শুধু তৃষ্ণা নিবারণ করে না, সোডা পান ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ায়। অন্যান্য মিষ্টি কোমল পানীয়র মতো সোডার মধ্যেও রয়েছে অ্যাসপার্টেমের মতো অনেক কৃত্রিম চিনি। আগেই বলা হয়েছে, অ্যাসপার্টেম অতি সুপরিচিত কারসিনোজেন (যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে)। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাসপার্টেম মস্তিষ্ক ক্যান্সার সৃষ্টির প্রবল ঝুঁকি বাড়ায়।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এক লাখ পঁচিশ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যারা কৃত্রিম চিনিসমৃদ্ধ সোডা পান করেন, তাদের মধ্যে লিউকেমিয়া, লিম্পোমা এবং মাল্টিপল মায়েলোমার প্রকোপ বাড়ে। কৃত্রিম চিনি ছাড়াও সোডায় থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও খাবারের রং যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে।

৮. লবণে জারিত বা ধূমশোধিত শূকরের মাংস, হটডগ, সালামি, মিটলোফ এবং সসেজ হল বহু মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খাবার। প্রক্রিয়াজাত মাংস নিঃসন্দেহে খেতে বেশ সুস্বাদু, সঙ্গে সঙ্গে এসব সুপরিচিত খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ায় বেশ দ্রুতগতিতে। প্রক্রিয়াজাত মাংসে সোডিয়াম নাইট্রেটের মতো ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ থাকে।

সোডিয়াম নাইট্রেটসহ অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে। নাইট্রেট খাওয়ার পর এন-নাইট্রোসো যৌগে রূপান্তরিত হয়। এসব মেটাবলিক যৌগ শরীরে ক্যান্সার তৈরিতে সাহায্য করে।

ধূমায়িত বা ধূমশোধিত মাংস উচ্চতাপে পোড়ানো হয় বলে নাইট্রেট বিক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রাইটে রূপান্তরিত হয়। এসব নাইট্রাইট খুব ক্রিয়াশীল কারসিনোজেন। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে হলে প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া কমাতে হবে বা বর্জন করতে হবে।

 

Kollol Khan

My professional background includes research and writing in the field of business.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button